
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের আজ ৮৯তম জন্মদিন। ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করা এই কিংবদন্তি কবি ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও, তার সাহিত্যকর্ম তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে অমরত্বে। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক হিসেবে তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন আপন মহিমায়।
আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন এক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর নিয়ে। তার কবিতা ছিল মাটি ও মানুষের কথা, গ্রামীণ জীবন আর লোকজ ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। একই সঙ্গে, নাগরিক জীবনের টানাপোড়েনও ধরা পড়েছে তার লেখনীতে। রফিক আজাদ তাকে ‘গ্রাম থেকে শহরে আসা এক আত্মপ্রত্যয়ী কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
তার পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। কিন্তু তিনি আল মাহমুদ নামেই পরিচিতি লাভ করেন। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জর্জ হাইস্কুলে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশিত হয়, যা বাংলা কাব্যধারায় এক নতুন মাত্রা যোগ করে। এরপর ‘কালের কলস’, ‘সোনালী কাবিন’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ তাকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
কবিতার পাশাপাশি সাংবাদিক হিসেবেও আল মাহমুদের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৫৪ সালে তিনি লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক কাব্য’ পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন তিনি। এরপর দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক ইত্তেফাক, এবং কর্ণফুলীসহ বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেন। দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৫ সালে তিনি শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক হিসেবে যোগ দেন এবং পরিচালক হিসেবে ১৯৯৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
আল মাহমুদের অন্যান্য সৃষ্টি
প্রথম দিকে সাহিত্যিক মহলে জায়গা করে নেওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু ‘লোক লোকান্তর’ (১৯৬৩) কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরই আলোচনায় আসেন আল মাহমুদ। এই কাব্যগ্রন্থ তাকে বাংলা কবিতার নতুন কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এরপর ‘কালের কলস’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে উঠো’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ তাকে নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায়।
আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’ বাংলা আধুনিক কবিতার এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। এই কাব্যগ্রন্থের সনেটগুলো বাংলা কবিতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। গ্রামীণ পটভূমি, লোকজ শব্দ ব্যবহার এবং প্রেমের এক ভিন্ন ধারার প্রকাশ ‘সোনালী কাবিন’-কে করে তুলেছে অবিস্মরণীয়।
সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা
আল মাহমুদের আরেকটি পরিচয় ছিল সাংবাদিক হিসেবে। ষাট ও সত্তরের দশকে তিনি কাজ করেছেন দৈনিক গণকণ্ঠ, দৈনিক ইনসাফসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক অবক্ষয় ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এসব অভিজ্ঞতা তার লেখনীকে করেছে আরও পরিপক্ব।
উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধে শক্তিমত্তা
কবিতা ছাড়াও আল মাহমুদের কথাসাহিত্য বাংলা সাহিত্যে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। ‘কবির মৃত্যু’, ‘দ্বিতীয় ভাঙন’, ‘উপমাহীন উপকূল’ কিংবা ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ উপন্যাসে তিনি গ্রামীণ জীবনের টানাপড়েন, দারিদ্র্য, প্রেম এবং আত্মিক সংগ্রামের বর্ণনা দিয়েছেন গভীর আবেগে। তার ছোটগল্প ‘লোকটি’, ‘মায়া’, ‘তোমার চোখে আলো দেখে’ পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে। তিনি ছিলেন একাধারে প্রাবন্ধিকও। তার ধর্ম, সাহিত্য ও জাতিসত্তা নিয়ে রচিত প্রবন্ধগুলো আজও পাঠযোগ্য।
ধর্মীয় আবেগ ও সাহিত্যচর্চা
আল মাহমুদের সাহিত্যজীবনের এক পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখি তার ধর্মীয় অনুরাগ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইসলামি ভাবধারা, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে তিনি সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন সাহসিকতার সঙ্গে। এক শ্রেণির পাঠকের মধ্যে এতে সহানুভূতি তৈরি হলেও, অন্যদিকে একাংশ তার এই ঝোঁককে রক্ষণশীলতার বলয়ে ফেলেন। তবে আল মাহমুদের ভাষা কখনো সংকীর্ণ ছিল না; বরং তার শব্দচয়ন, উপমা এবং দৃশ্যপট সবসময় ছিল কবিতার প্রয়োজনেই।
পুরস্কার ও সম্মাননা
সাহিত্যকর্মে অসামান্য অবদানের জন্য আল মাহমুদ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮), একুশে পদক (১৯৮৭), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার, এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত ত্রিকাল সাহিত্য পুরস্কার।
আল মাহমুদ শুধু একজন কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দ্রষ্টা, একজন স্বপ্নচারী। তার লেখায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ এবং সংস্কৃতির এক অনবদ্য চিত্র। তিনি বাংলা কবিতার যে ধারা তৈরি করে গেছেন, তা আজও তরুণ কবিদের অনুপ্রাণিত করে।
মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫
প্রকাশের তারিখ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের আজ ৮৯তম জন্মদিন। ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করা এই কিংবদন্তি কবি ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও, তার সাহিত্যকর্ম তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে অমরত্বে। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক হিসেবে তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন আপন মহিমায়।
আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন এক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর নিয়ে। তার কবিতা ছিল মাটি ও মানুষের কথা, গ্রামীণ জীবন আর লোকজ ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। একই সঙ্গে, নাগরিক জীবনের টানাপোড়েনও ধরা পড়েছে তার লেখনীতে। রফিক আজাদ তাকে ‘গ্রাম থেকে শহরে আসা এক আত্মপ্রত্যয়ী কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
তার পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। কিন্তু তিনি আল মাহমুদ নামেই পরিচিতি লাভ করেন। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জর্জ হাইস্কুলে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশিত হয়, যা বাংলা কাব্যধারায় এক নতুন মাত্রা যোগ করে। এরপর ‘কালের কলস’, ‘সোনালী কাবিন’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ তাকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
কবিতার পাশাপাশি সাংবাদিক হিসেবেও আল মাহমুদের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৫৪ সালে তিনি লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক কাব্য’ পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন তিনি। এরপর দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক ইত্তেফাক, এবং কর্ণফুলীসহ বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেন। দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৫ সালে তিনি শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক হিসেবে যোগ দেন এবং পরিচালক হিসেবে ১৯৯৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
আল মাহমুদের অন্যান্য সৃষ্টি
প্রথম দিকে সাহিত্যিক মহলে জায়গা করে নেওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু ‘লোক লোকান্তর’ (১৯৬৩) কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরই আলোচনায় আসেন আল মাহমুদ। এই কাব্যগ্রন্থ তাকে বাংলা কবিতার নতুন কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এরপর ‘কালের কলস’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে উঠো’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ তাকে নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায়।
আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’ বাংলা আধুনিক কবিতার এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। এই কাব্যগ্রন্থের সনেটগুলো বাংলা কবিতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। গ্রামীণ পটভূমি, লোকজ শব্দ ব্যবহার এবং প্রেমের এক ভিন্ন ধারার প্রকাশ ‘সোনালী কাবিন’-কে করে তুলেছে অবিস্মরণীয়।
সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা
আল মাহমুদের আরেকটি পরিচয় ছিল সাংবাদিক হিসেবে। ষাট ও সত্তরের দশকে তিনি কাজ করেছেন দৈনিক গণকণ্ঠ, দৈনিক ইনসাফসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক অবক্ষয় ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এসব অভিজ্ঞতা তার লেখনীকে করেছে আরও পরিপক্ব।
উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধে শক্তিমত্তা
কবিতা ছাড়াও আল মাহমুদের কথাসাহিত্য বাংলা সাহিত্যে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। ‘কবির মৃত্যু’, ‘দ্বিতীয় ভাঙন’, ‘উপমাহীন উপকূল’ কিংবা ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ উপন্যাসে তিনি গ্রামীণ জীবনের টানাপড়েন, দারিদ্র্য, প্রেম এবং আত্মিক সংগ্রামের বর্ণনা দিয়েছেন গভীর আবেগে। তার ছোটগল্প ‘লোকটি’, ‘মায়া’, ‘তোমার চোখে আলো দেখে’ পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে। তিনি ছিলেন একাধারে প্রাবন্ধিকও। তার ধর্ম, সাহিত্য ও জাতিসত্তা নিয়ে রচিত প্রবন্ধগুলো আজও পাঠযোগ্য।
ধর্মীয় আবেগ ও সাহিত্যচর্চা
আল মাহমুদের সাহিত্যজীবনের এক পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখি তার ধর্মীয় অনুরাগ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইসলামি ভাবধারা, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে তিনি সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন সাহসিকতার সঙ্গে। এক শ্রেণির পাঠকের মধ্যে এতে সহানুভূতি তৈরি হলেও, অন্যদিকে একাংশ তার এই ঝোঁককে রক্ষণশীলতার বলয়ে ফেলেন। তবে আল মাহমুদের ভাষা কখনো সংকীর্ণ ছিল না; বরং তার শব্দচয়ন, উপমা এবং দৃশ্যপট সবসময় ছিল কবিতার প্রয়োজনেই।
পুরস্কার ও সম্মাননা
সাহিত্যকর্মে অসামান্য অবদানের জন্য আল মাহমুদ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮), একুশে পদক (১৯৮৭), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার, এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত ত্রিকাল সাহিত্য পুরস্কার।
আল মাহমুদ শুধু একজন কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দ্রষ্টা, একজন স্বপ্নচারী। তার লেখায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ এবং সংস্কৃতির এক অনবদ্য চিত্র। তিনি বাংলা কবিতার যে ধারা তৈরি করে গেছেন, তা আজও তরুণ কবিদের অনুপ্রাণিত করে।
মোবাইল নাম্বারঃ +8801602460060
Email: hr.channela@gmail.com
বিজ্ঞাপনঃ +8801602460060
info@channelabd.com
আপনার মতামত লিখুন